মাশরুম চাষে ছত্রাক
নাশক ঝুুঁকিপূর্ণ
ঢাকার একটি সুপার শপে এ গরমে বাংলাদেশে উৎপাদিত বাটন মাশরুম দেখে আমি মুগ্ধ। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় বাংলাদেশে বাটন মাশরুম উৎপন্ন হচ্ছে। এটি আরো বেশি আনন্দের এই জন্য কোনো রকম সরকারি সহযোগিতা ছাড়া উৎপাদন করেছে এ দেশের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। বিশ্বসেরা বাটন মাশরুমের জন্য প্রথম উপাদানের কম্পোস্ট। মানসম্মত কম্পোস্ট তৈরি করতে পারলে প্রাকৃতিক পরিবেশে শীতে এ দেশে যে কেউ এ বাটন মাশরুম উৎপাদন করতে পারবে। মানসম্মত কম্পোস্ট তৈরি করার প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশের কম্পোস্ট তৈরি এবং সর্বোপরি বাটন মাশরুম উৎপাদন কৌশল অনুকরণ করা যেতে পারে। অনুকরণ করলে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের দেশে শীতে বাটন মাশরুম হবে। বাটন মাশরুম চাষের জন্য ধানের খড় ও গমের ভুসির সঙ্গে চুন ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও ৬৫% পানি ব্যবহার করে কম্পোস্ট তৈরি করতে হয়। আমাদের দেশে বাটনের এ কম্পোস্ট তৈরির জন্য অনেকে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে বলেন। কিন্তু মাশরুমের বিজ্ঞান বলছে, বাটন মাশরুমের কম্পোস্ট করতে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
দুধ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে আমাদের জন্য যেমন দই তৈরি হয় তেমনি ধানের খড় বা গমের খড় দিয়ে হয় বাটনের কম্পোস্ট। বাটন মাশরুমের কম্পোস্ট একটি বিশেষ ধরনের শিল্পজাত দ্রব্য। এ শিল্পকে বিজ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করতে না পারলে আমরা বাটন মাশরুম করতে পারব না। বাটন মাশরুমের কম্পোস্টিং প্রক্রিয়ায় ধান বা গমের খড়ে প্রাকৃতিকভাবে থাকা ঐঁসরপড়ষধ মৎরংবধ নামক থার্মেফিলিক ছত্রাক এবং ঝঃৎবঢ়ঃড়সুপবং ংঢ়ঢ় জাতীয় কিছু ফিলামেন্টাস ব্যাক্টেরিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে এ ছত্রাক বিলুপ্ত হয়, ফলে কম্পোস্টটি আর বাটন মাশরুমের জন্য উপযোগী থাকে না। আমাদের ঢাকার সাভারের মাশরুম চাষিদের দেখেছি তারা ৩০০ কেজি ধানের খড়ের জন্য ১৫০ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম ব্যবহার করে, অর্থাৎ ৫০০ পিপিএম। এই মাত্রায় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে সেই কম্পোস্টে কোনো ছত্রাক জীবিত থাকতে পারবে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশের ওহফরধহ ঈড়ঁহপরষ ড়ভ অমৎরপঁষঃঁৎধষ জবংবধৎপয (ওঈঅজ) বাটন মাশরুমের ওপর অনেক কম্পোস্টিং ফরমুলা দিয়েছে, সেখানে কোনো ছত্রাকনাশকের ব্যবহার নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে নেই, থাকতে পারে না। মাশরুম চাষের বিজ্ঞান না জেনে আমাদের এ মাশরুম চাষিরা এ শিল্পের প্রসার ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাটন মাশরুমের টিস্যুকালচার করতে বিশেষ ধরনের মিডিয়ার ব্যবহারও প্রয়োজন। আমাদের মাশরুম চাষিরা এখনো সেগুলোয় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
মাশরুম উচ্চশ্রেণির ছত্রাক তাই ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করাটাই বাঞ্ছনীয়, তবে ওয়েস্টার মাশরুম চাষে-প্রয়োজনে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্তু তার জন্য তাত্তি্বক জ্ঞান জরুরি। এ বিষয়ে যে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো_ যখন আমরা খোলা মাঠে জমিতে প্রয়োগ করি তখন ছত্রাকনাশকের মাত্রা হিসেব করতে হয় গ্রাম/লিটার, কিন্তু যখন ইনভিট্রো পরীক্ষণ করি যেমন মাশরুম প্যাকেটের ভেতরে, টেস্টটিউবে, পেট্রিডিসে বা বোতলে ব্যবহার করি তখন দিতে হয় মিলিগ্রাম/লিটার (বা কেজি) হিসেবে। কার্বেন্ডাজিম নামক ছত্রাকনাশকটি মাশরুম চাষে সর্বোচ্চ যে মাত্রায় ব্যবহার করার অনুমতি আছে তার ২০ গুণ বেশি মাত্রায় এর ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের কোমলমতী মাশরুম চাষিরা। মাত্রাতিরিক্ত কার্বেন্ডাজিম ব্যবহার করলে এক সময় মাশরুমের জাতগুলোর জেনেটিক চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে। একবার ঢাকার সাভারে অবস্থিত আমার এক প্রিয় ছোটভাই ফোন করে বলল, 'দাদা আমার সব ওয়েস্টার মাশরুম ছাতার মতো না হয়ে কেমন যেন কলমিফুলের মতো বা মাইকের মতো হয়ে গেছে। মাশরুমগুলো খাড়া না হয়ে ছোট্ট কানের দুলের মতো ঝুলছে, ফলন মারাত্মকভাবে কমে গেছে।' এ মারাত্মক ফলন হ্রাস পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর জাতগত জেনেটিক গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে এ মাশরুমের টিস্যু নিয়ে আর মাদার কালচার তৈরি করা যাবে না। অন্য জায়গা থেকে আবার জাত সংগ্রহ করতে হবে। আপনার মতো সবার যদি এ একই রকম অবস্থা হয় তবে জাতটি দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। তাই অর্গানিক সবজি মাশরুম চাষে ছত্রাকনাশকসহ কোনো রকম রাসায়নিক ব্যবহার না করলেই আমাদের মাশরুমগুলো রক্ষা পায়। কার্বেন্ডাজিম সিস্টেমিক ছত্রাকনাশক এবং মারাত্মক মিউটাজেনিক গুণসম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেটি সবুজ ফসলের ছত্রাক দমনে ব্যবহার করলে ছত্রাকগুলো তার নতুন রেস তৈরি করে, ফলে পরে এ ছত্রাকনাশকের মাত্রা আরো বাড়াতে হয়, একসময় ওই ছত্রাক-জীবাণুগুলো এ ছত্রাকনাশকের প্রতি আর সংবেদনশীল থাকে না।
সবুজ ফসলের ক্ষেত্রে চাষিরা কোন ফসলে এটিকে মৌসুমে ২-৩ বার ব্যবহার করলে এটির রেজিস্ট্যান্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, আমরা জানি এ ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিমান চাষিরা ক্রপ-রোটেশন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু মাশরুমের ক্ষেত্রে এ ছত্রাকনাশকটি কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়া সারা বছরই নির্বিচারে ব্যবহারের চর্চা আমাদের মাশরুমের যাত্রাকে থামিয়ে দেবে বা দিয়েছে। মাশরুম উচ্চ শ্রেণির ছত্রাক, তাই এ ছত্রাকনাশক ব্যবহারে মাশরুমের প্রথমদিকে আপাত উপকার করছে বলে মনে হলেও পরে দেখা যাবে জাতটির স্থায়ী গুণগত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এভাবে ২৫ বছর ধরে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় অভিযোজিত মাশরুম জাতটির হয়তো ক্ষতি করে ফেলছি আমরা নিতান্ত অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে। বিংশ শতাব্দীর এ শ্রেষ্ঠ ফসল মাশরুমের অগ্রগতির জন্য দরকার দক্ষ মানবসম্পদ আর নতুন কর্মকৌশল। আমাদের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা আবার কৃষির দিকে ফিরে আসছে। জীববিজ্ঞান ও কৃষিবিজ্ঞানের গবেষকদের মাশরুম বিষয়ে গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তবেই এ দেশ দ্রুত মাশরুম শিল্প এগিয়ে যাবে। মাশরুমশিল্পে শিক্ষিত নর-নারীর অংশগ্রহণ দেখে মনটা খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে- মনে হয় এ দেশে মাশরুম শিল্প এগিয়ে যাবেই। একবার শুরু করলে বাঙালিকে আর থামায় কে?
লেখক : শিশির চৌধুরী, গবেষক ও
কৃষিউন্নয়ন বিশ্লেষক
Source: http://www.jjdin.com
No comments:
Post a Comment