Pages

Wednesday, May 7, 2014

যে পারে সে করে, যে পারে না সে শেখায়!

যে পারে সে করে, যে পারে না সে শেখায়!

- শ্যামলী তঞ্চঙ্গা | ২০১৪-০৬-২১ ইং


 মাশরুম নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি লেখায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে। ‘জাতীয় মাশরুম: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ শীর্ষক লেখাটিতে শিশির চৌধুরী মাশরুম চাষের প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয়তা লিখেছেন এবং তিনি মাশরুম চাষের বিজ্ঞানকে অল্প পরিসরে যতটা সম্ভব উজাড় করে দিয়েছেন। যিনি কাজটি জানবেন তিনিই তা করবেন। এমনটাই নিয়ম, কিন্তু জাতীয় মাশরুম প্রকল্পে তেমনটি ঘটেনি। তাই বিশিষ্ট ব্রিটিশ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ’র কথাটি মনে পড়ছে, ‘যে পারে সে করে আর যে পারে না সে শেখায়।’ আর সেজন্যই ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি প্রকল্প বিশ্বসেরা বাটন মাশরুম উত্পাদন করতে পারেনি, অথচ সেটি সাফল্যের সঙ্গে করে ঢাকার বাজারে বিপণন করছে এ দেশেরই একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের লোকদের অজ্ঞতা এবং সর্বোপরি প্রকল্পের কর্মকাণ্ড জনবান্ধব না হওয়ায় একসময়ে সহযোগিতাপ্রাপ্ত মাশরুম চাষীরা বর্তমানে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। এটি মাশরুমকে রক্ষার জন্যই বলে আমি বিশ্বাস করি। শরীরে কোথাও ব্যথা বা অন্য কোনো লক্ষণ দেখা দিলে আমরা চিকিত্সকের কাছে যাই। বরং ব্যথাহীন ক্যান্সার ক্ষতিকর, তাই মাশরুম চাষীদের প্রতিবাদকে জাতীয় মাশরুমের রোগের নিদান তত্ত্বের উপকরণ ভেবে আবার এগিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। মাশরুম উত্পাদন ও সম্প্রসারণের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সব তাত্ত্বিক গবেষণা সীমিত রেখে চাষীবান্ধব গবেষণার কাজ হাতে নেয়া জরুরি। মাশরুম চাষের জন্য বিজ্ঞানসম্মত চাষঘর দরকার। জাতীয় মাশরুম কেন্দ্রে যে মাশরুম চাষঘর আছে, তা চাষের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। এ ঘরগুলোয় শুধু শীতে কিছু মাশরুম পাওয়া যায়। গরমে এখানে মাশরুম হয় না। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এ অসারতা ব্যর্থতার মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।
মাশরুম বিপণনকে সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় নতুন কিছু জাত বাজারে পরিচিত করতে পারলে মাশরুম নতুন গতি পেত। আমার মনে হয় মাশরুমকে ইচ্ছে করেই কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। তাই তো শিশির চৌধুরী শঙ্কা অনুভব করে লিখেছেন, সরকারি মাশরুম প্রতিষ্ঠানকে ব্যর্থ করে দিয়ে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী মাশরুমের প্রাইভেট শিল্পকে চাঙ্গা করতে ষড়যন্ত্র করছে না তো! আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, মাশরুম শিল্পের প্রসারে মাশরুম প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় মাইকোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট ও এন্টোমলজিস্ট দরকার। প্রকল্প পরিচালক একজন দক্ষ প্রশাসক হয়ে এসব বিষয়ের গবেষণার সুনাম উপভোগ করবেন, তিনি কখনই স্বপ্নে পাওয়া ভুল ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আবেগী হয়ে নিজের মনগড়া দর্শন বাস্তবায়নে মাশরুমের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবেন না।
মাশরুম সম্প্রসারণের জন্য হাজার হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণের পুরনো কৌশল অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে উদ্দেশ্য সুবিবেচনায় রেখে সারা বাংলাদেশে প্রথমে বিভাগীয় শহরে এবং পরে বড়-বড় জেলা শহরে মাশরুম শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। ‘মাশরুম চাষ খুব সহজ ও খুবই লাভজনক’— সাধারণ মানুষকে এই প্রতারণার ফাঁদে না ফেলে মাশরুমের চাষ প্রযুক্তি জেনে অন্যকে শেখাতে হবে। মাশরুম চাষ জানতে হলে পড়তে হবে। এজন্য মানসম্মত টেক্সট বই কিনতে হবে। শুধু পিএইচডি ডিগ্রি একজনকে বিশেষজ্ঞ করে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ক্রয়ের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে সচেতন হতে হবে। বিশেষজ্ঞ হতে হলে প্রচুর পাঠ করতে হয়, জাতীয় মাশরুম সেন্টারে এর ওপর ভালো মানের বই নেই, হয়তো বিল-ভাউচারে এবং নথিপত্রে থাকতে পারে। অর্থাত্ কাজীর গরু গোয়ালে নেই, আছে ফাইলের ভেতর। অথচ গরুর জন্য ঘাস-খড়কুটো কেনার বিল-ভাউচার করে অর্থ লুটপাট চলছে। 
আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মাশরুম সম্পর্কে শেখায় না। সেখানে বেসিক মাইকোলজির পাঠও তেমন হয়ে ওঠে না। তাই মাশরুমের তাত্ত্বিক জ্ঞান না জেনে কিছু ‘অর্থহীন’ গবেষণা ও গবেষণাপত্র রচনা করে প্রজাতন্ত্রের কতিপয় কর্মকর্তার বায়োডাটা বড় হতে পারে, তাতে মাশরুম উত্পাদন ও সম্প্রসারণ হবে না। এদের গবেষণা ও প্রশিক্ষণের একটু নমুনা তুলে ধরতে চাই। মাশরুম প্রশিক্ষণের এক ম্যানুয়ালে মিলকি মাশরুম চাষের একপর্যায়ে লেখা হয়েছে, ‘প্রখর রোদে বসে স্তরে স্তরে খড়ের মধ্যে মাশরুমের মাতৃবীজ ছড়িয়ে দিতে হবে।’ আমি পড়াশোনা করে দেখেছি, এর কোনো প্রয়োজন নেই। এত গেল সাধারণ চাষীদের জন্য বিশেষ কমেডি পাঠ, মূল গবেষণায়ও এদের কমেডি চোখে পড়ে। যেমন— এদের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকে ইফেক্ট অব ওয়াটারিং অর্থাত্ মাশরুম উত্পাদনে পানির প্রভাব। অথচ এমনটি গবেষণা করে তা ইংরেজিতে প্রবন্ধাকারে ছাপালে এটি দেশে বা বিদেশে কারো কোনো প্রয়োজনে আসবে না। কেননা মাশরুমের ফলনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রার আপেক্ষিক আর্দ্রতা দরকার হয়, সেটি বাণিজ্যিক উত্পাদনকারীরা যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করে থাকেন। আমাদের গরিব গ্রামীণ চাষীরা সেটি করতে গেলে ক্ষণে ক্ষণে পানি স্প্রে করতে হবে। এজন্য চৈত্রের ক্ষরায় হয়তো পানি স্প্রে করতে হবে ৫-৭ বার আবার কদমফোটা বর্ষায় হয়তো পানি স্প্রে করার প্রয়োজন হবে না। মাশরুম উত্পাদনের জন্য সারা বিশ্বে কত মূল্যবান গবেষণা হচ্ছে, আর আমাদের কৃষিবিদরা সাভারের মাশরুমকে শুধু পানি খাওয়াচ্ছেন!
সম্মানিত পাঠক, একটি গল্প বলছি শুনুন— এক পোলট্রি ফার্মের মুরগির বাচ্চা ও ডিম বাজারের সেরা। এক লোক পোলট্রির মালিকের প্রশংসা করে বললেন, ‘এত চমত্কার ডিম ও বাচ্চা উত্পাদনের জন্য আপনার মুরগিগুলোকে কী খেতে দেন?’ ‘বাজারের সেরা সব খাবার। আলমন্ড, পেস্তা বাদাম এবং খাটি ঘি মিশিয়ে তৈরি করা হয় মুরগির খাবার’— গর্বের সঙ্গে উত্তর দিলেন মালিক। প্রশ্নকারী বললেন, ‘বেশ মজার তো! ‘আমি আয়কর বিভাগ থেকে এসেছি। আমি জানতে চাই যে, আপনি মুরগির জন্য এত ব্যয়বহুল খাবার কেনার অর্থ কোত্থেকে পান?’ পোলট্রি খামার মালিক সতর্ক হলেন এ ঘটনার পর। পরবর্তী দর্শনার্থী তার ডিম ও বাচ্চার প্রশংসা করে জানতে চাইলেন, ‘আপনার মুরগিকে কী খেতে দেন?’ মালিক বললেন, ‘কিছুই খেতে দিই না। মুরগিগুলোকে ক্ষুধার্ত রাখি।’ দর্শনার্থী বললেন, ‘তাহলে তো আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। আমি পশুপাখির ওপর নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ সমিতি থেকে এসেছি। মুরগিগুলোকে খেতে না দেয়ার অপরাধে আপনাকে জরিমানা করছি।’ এরপর এলেন আরেক ব্যক্তি। একই ধরনের প্রশ্ন তার। পোলট্রি মালিক এবার প্রশ্নের উত্তর দিতে আরো সতর্ক। তিনি বললেন, ‘আমি প্রত্যেক মুরগিকে পঞ্চাশ পয়সা করে দিই, যাতে তারা তাদের পছন্দমতো খাবার কিনে খেতে পারে।’ সম্মানিত পাঠক গুরুত্বপূর্ণ মাশরুম বিষয়ে বলতে গিয়ে একটু কমেডির আশ্রয় নিলাম, কারণ আমাদের জাতীয় মাশরুমের কর্মকাণ্ড আরো বেশি কমেডিতে ভরপুর।


লেখক: মাশরুম উদ্যোক্তা
shyamolitg@gmail.com


No comments:

Post a Comment